বিশ্বের সেরা ১০ কভার্ট অপারেশন: যেগুলির নাম শুনলে কাঁপে অনেকেই

Post Image

আন্ডারকভার এজেন্ট৷ সিক্রেট সার্ভিস৷ কভার্ট অপারেশন৷ যা সব শুনলেই আপনার চোখে ভেসে উঠতে পারে সিআইএ, এফএসবি, এমআই সিক্স, মোসাদের মতো বিশ্বখ্যাত (কারও কারও কাছে কুখ্যাত) সব সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সির নাম৷ কিংবা মনে পড়ে যেতে পারে কুখ্যাত সব মিলিটারি স্কোয়াডের কথা৷

আজ এই প্রতিবেদনে আমরা আপনাদের জানাব, বিশ্বের সেরা ১০টি কভার্ট অপারেশনের কথা৷ যে সমস্ত অপারেশনের কথা জানলে আপনিও শিউরে উঠবেন৷

১০. অপারেশন পেপারক্লিপ:

সদ্য তখন শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ আমেরিকা, ব্রিটেন এবং রাশিয়া মিলে এই কোভার্ট অপারেশেনর ছক কষেছিল৷ মিশনের লক্ষ্য ছিল কয়েকজন নাৎসি বিজ্ঞানী এবং নাৎসি সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টকে কয়েদ করা৷ মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র নেতৃত্বে এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল পেপারক্লিপ৷ পেপারক্লিপ অপারেশন সফল হয়েছিল৷ বিখ্যাত নাৎসি বিজ্ঞানী ভন ব্রাউন এবং আর্থার রুডলফকে জালে পুরেছিল সিআইএ৷

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা এবং চন্দ্র অভিযানে এই দুই বিজ্ঞানীরও অবদান ছিল৷ কিন্তু এরাই পরবর্তীকালে নাৎসিদের হয়ে বহু বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করেছিলেন৷ যার ফলস্বরূপ এদের ধরতে কোভার্ট অপারেশন করেছিল সিআইএ৷ এছাড়াও এই অপারেশেনে ধরা পড়েছিল নাৎসি গুপ্তচর সংস্থার ডিরেক্টর রেইনহার্ড গেহলেন৷ যিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি পৃথক গুপ্তচর স্কোয়াড তৈরি করেছিলেন৷ শুধু তাই নয় ইজরায়েল সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি মোসাদ তৈরিতেও রেইনহার্ডের অবদান ছিল৷

৯.অপারেশন এম কে আল্ট্রা

উত্তর কোরিয়ার মগজধোলাই শিবিরকে (ব্রেনওয়াশিং প্রোগ্রাম) এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক বলা চলে৷ কারও স্মৃতিকে তাঁর মস্তিস্ক থেকে মুছে দেওয়ায় এই অপারেশেনর লক্ষ্য৷ স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার জন্য যে উপায়গুলি সিআইএ অবলম্বন করত তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল৷ এক্ষেত্রে কাউকে দিনের পর দিন এলএসডি’র মতো মারণ ড্রাগ দেওয়া হতো৷ যাতে সে কোনও গোপন তথ্য শত্রুপক্ষের কাছে চাইলেও ফাঁস না করতে পারে৷ কোনও কোনও সময় হিপনোটাইজও করা হত৷

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাই ডোজের ড্রাগের ব্যবহার করা হতো৷ এক্ষেত্রে একটি ঘটনায় একজনকে দীর্ঘ ৭৭ বছর ধরে টানা ‘এলএসডি’ দেওয়া হয়েছিল৷ ফলস্বরূপ সেই ব্যক্তি কোমায় চলে যান৷ শোনা যায় কোনও কোনও সময় সিআইএ নিজেদের অবসরপ্রাপ্ত এজেন্টদের ওপরও অপারেশন এম কে আল্টা প্রয়োগ করে থাকে৷

৮. অপারেশন অ্যান্ত্রোপোয়েড

১৯৪২ সালে নাৎসি কমান্ডার রেইনহার্ড হেড্রিককে হত্যা করার ছক কষেছিল ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআই সিক্স৷ চেকোস্লোভাকিয়ায় ব্রিটেনের মিলিটারি বেস ক্যাম্প থেকে এই অপারেশেনর জন্য দুজনকে নির্বাচন করেছিল এমআই সিক্স৷ ১৯৪২ সালের ২৭ মে ঘটে সেই হত্যাকাণ্ড৷ কীভাবে ঘটানো হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড?

একটি ব্যস্ত রাস্তায় ট্রামের মধ্যে একেবারে জানলার ধারে বসেছিল ওই দুই এজেন্ট৷ সেই সময় ট্রামের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায় কমান্ডার রেইনহার্ডের হুটখোলা গাড়ি৷ একজন এজেন্ট ট্রামের জানলা থেকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুঁড়তে যায়, আর তখনই বন্দুকের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রিগার আটকে যায়৷ সেই সময় তা দেখতে পেয়ে পালটা গুলি চালায় কমান্ডার রেইনহার্ড৷ গাড়ি থেকে নেমে পড়েন তিনি৷ আর সেই সময় আরেক এজেন্ট রেইনহার্ডের গাড়িতে গ্রেনেড ছোঁড়ে৷ প্রবল বিস্ফোরণে গাড়িটি উড়ে যায়৷ কমান্ডার রেইনহার্ড মারাত্মকভাবে জখম হন৷ সেই সময় বেঁচে গেলেও হাসপাতালে অপারেশেনর কয়েকদিন পরই তিনি মারা যান৷

৭.অপারেশন প্লুটো

এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করা৷ অবশ্যই নেতৃত্বে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ৷ জে এফ কেনেডি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট৷ বিশেষভাবে উল্লেখ্য দক্ষিণ কিউবায় এই অপারেশনেক সংঘটিত করার জন্য কোনও আমেরিকান নয়, নিয়োগ করা হয়েছিল কয়েকজন কিউবার নাগরিককেই৷ কিন্তু কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তাই তাঁকে সে বার বাঁচিয়ে দিয়েছিল৷ আকাশপথে হামলা চালিয়েও কোনও লাভ হয়নি আমেরিকার৷ কারণ কিউবার স্থানীয় বাসিন্দারাই কাস্ত্রোর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন৷

তাঁকে হামলার সময়ই নিরাপদে অন্যত্রে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ অপারেশন প্লুটো সাফল্য না পেলেও এর তাৎপর্য এতটাই গভীর যে একে সেরা ১০ কোর্ভাট অপারেশেন তালিকায় রাখা হয়৷ এখানে বলে রাখা ভালো, অপারেশন প্লুটো ফেল হওয়ার জন্য তৎকালীন সিআইএ ডিরেক্টরের চাকরি গিয়েছিল৷

৬. অপারেশন ওয়ার্থ অফ গড

বিশ্বের সেরা কোভার্ট অপারেশনগুলির মধ্যে বহুল আলোচিত৷ ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এই অপারেশন চালিয়েছিল৷ ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক চলাকালীন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামের একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এগারোজন ইজারায়েলের অ্যাথলিটকে অপহরণ করে হত্যা করেছিল৷ এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অপারেশন ওয়ার্থ অফ গড প্ল্যান করে মোসাদ৷ জানলে অবাক হবেন এই অপারেশন চলাকালীন সারা ইউরোপ থেকে ওই জঙ্গিদের খুঁজে খুঁজে বার করে হত্যা করেছিল মোসাদের এজেন্টরা৷ আর এক একজনকে মারার কৌশলও ছিল চমকপ্রদ৷ যেমন কোরান শরিফের মধ্যে রাখা হয়েছিল বোমা৷ যা খুলতেই বিস্ফোরণে এক জঙ্গির মৃত্যু হয়েছিল৷ প্রায় ১০ বছর ধরে ১২ জন জঙ্গিকে খুঁজে খুঁজে তাদের মেরেছিল মোসাদ৷ যা গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে আজও ‘এপিক’ বলে মনে করা হয়৷

 
৫.অপারেশন পে ব্যাক

যদিও এটি কোনও দেশের নির্দিষ্ট কোনও সিক্রেট এজেন্সির অপারেশন নয়৷ তবুও যেভাবে সিক্রেট অপারেশনের কায়দায় এই গোটা ব্যাপারটিকে সংঘটিত করা হয়েছিল৷ তা উল্লেখযোগ্য কোভার্ট অপারেশন ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না৷ এটা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য বিভিন্ন আপদকালীন পরিষেবাকে পরপর স্তব্ধ করে দেওয়া৷ গোয়েন্দাদের ভাষায় যাকে বলা হয় ডিওএস অ্যাটাক (ডিনায়াল অফ সার্ভিস)৷ একটি বেনামি সিক্রেট এজেন্সি এই অপারেশন চালিয়েছিল৷

ইরাকে যুদ্ধসম্পর্কিত বহু গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল উইকিলিক্স৷ এরপরই ভিসা, পে প্যাল, মাস্টার কার্ডের মতো বহু সংস্থা উইকিলিক্সের সঙ্গে তাঁদের চুক্তি ভঙ্গ করে৷ ফলে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল উইকিলিক্স৷ এরই প্রতিবাদ স্বরূপ এই সমস্ত সংস্থার সমস্ত ওয়েবসাইট হ্যাক করে পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছিল ওই বেনামি সংগঠন৷ হ্যাকাররা এই সব ওয়েবসাইটে লিখে দিয়েছিল ‘পে ব্যাক’৷ আদতে কারা এই হ্যাকিংয়ের পিছনে ছিল তা আজও জানা যায়নি৷ উইকিলিক্সকে আপাততভাবে সন্দেহ করা হলেও পরে এই সংস্থাকে ক্লিনচিট দেওয়া হয়েছিল৷

৪.অপারেশন আইচ

বিশ্বের সেরা কোভার্ট অপারেশনগুলির মধ্যে একটি এই অপারেশন৷ যে অপারেশেনর পরিকল্পনা করেছিলেন হিটলার৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সিশলির আক্রমণে পতন হয় ইতালির সরকারের৷ মুসোলিনিকে গ্রেফতার করা হয়৷ ইতালির গ্রান সাসো এলাকায় সেই সময় বন্দিজীবন কাটাচ্ছিলেন মুসোলিনি৷ তাঁকে উদ্ধার করতে একটি কোর্ভাট অপারেশন প্ল্যান করেন হিটলার৷ অত্তো সাকোরজি নামে এক এজেন্টকে এই অপারেশেনের দায়িত্ব দেওয়া হয়৷

সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টদের মাধ্যমে মুসোলিনির লোকেশন জানার পরই সেখানে প্যারাট্রুপের মাধ্যমে হামলা চালায় সাকোরজি৷ এই গোটা অপারেশেনে প্যারা ট্রুপের একজন মাত্র সদস্য নিহত হন৷ কিন্তু সফলভাবে সেইদিন মুসোলিনিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল৷

৩.অপারেশন এন্তেবে

ইজরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর আরও এক দুঃসাহসিক অভিযান৷ ৪ জুলাই,১৯৭৬ এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমানকে হাইজ্যাক করে প্যালস্তাইন জঙ্গিরা৷ এথেন্স থেকে প্যারিস যাওয়ার পথে যাত্রীবাহী বিমানটিকে হাইজ্যাক করা হয়৷ নামানো হয় উগান্ডার এন্তেবে বিমানঘাঁটিতে৷ বিমানটিতে বহু ইজরায়েলের নাগরিকও ছিলেন৷ গভীর রাতে সেই বিমান ঘাঁটিতে অভিযান চালায় ১০০ জন ইজরায়েলের কমান্ডো৷ তিনটি হারকিউলিস হেলিকপ্টারে করে সেই বিমান ঘাঁটিতে নামে কমান্ডো বাহিনী৷ ইজরায়েল বাহিনীর এই আচমকা হানায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা৷ অপারেশনটি শেষ করতে মাত্র ৩৫ মিনিট নিয়েছিল ইজরায়েল বাহিনী৷ তিনজন পণবন্দি এবং একজন কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছিল৷ তবে বাকি সকল পণবন্দিকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল৷

২. অপারেশন নেপচুন স্পেয়ার

এই অপারেশন সম্পর্কে কমবেশি সকলেই জানেন৷ লাদেন নিকেশ অভিযান৷ সিআইএ যার নাম দিয়েছিল অপারেশন নেপচুন স্পেয়ার৷ পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের বিলাল টাউনে ওসামা বিন লাদেনের সেফ হাউসে হানা দিয়েছিল মার্কিনি স্পেশাল স্কোয়াড৷ রাতের অন্ধকারে এই স্কোয়াড হামলা চালাতে পারদর্শী তাই এই স্কোয়াডকে বলা হয় নাইট স্টকার্স৷ দুটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার এবং দুটি চিনক্স নিয়ে অ্যাবোটাবাদে ল্যান্ড করেছিল মার্কিন সেনা বাহিনী৷ এছাড়াও অ্যাবোটাবাদের অদূরেই ঘাঁটি গেড়েছিল মার্কিনি নৌসেনাও৷ লাদেনের সেফ হাউসের তিনতলায় তাঁকে খুঁজে পেতেই দু’বার গুলি করা হয় তাঁকে৷ এরপর তাঁর দেহকে সাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মার্কিন সেনা বাহিনী৷

১. অপারেশন ভালকিরি

যদিও একটুর জন্য এই অপারেশন সফল হয়নি৷ তবুও এর লক্ষ্যর জন্য বিশ্বের তামাম কোভার্ট অপারেশেনে এটিই পয়লা নম্বর৷ আর হবে নাই বা কেন? এই অপারেশন ছিল হিটলারকে হত্যা করার ছক৷

১৯৪৪ সাল৷ জার্মানিতে তখন ধীরে ধীরে হিটলার বিরোধী শক্তি ডালাপালা মেলছে৷ জার্মান সেনাতেই হিটলার বিরোধী হাওয়া বইছিল৷ ক্লাউজ ভন স্টাফেনবার্গ নামের এক সেনা আধিকারিকই হিটলারকে মারার পরিকল্পনা করেন৷ তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল বেশ কয়েকটি নাৎসি বিরোধী সংগঠনও৷ দু’দবার এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এসেছিলেন ক্লাউজ৷ কারণ তিনি চেয়েছিলেন শুধুমাত্র হিটলার নয় একই সঙ্গে আরও কয়েকজন হিটলার ঘনিষ্ঠকেও তিনি শেষ করবেন৷

১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই৷ সেদিন হিটলার সেনা আধিকারিক এবং নিজের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে একটি কনফারেন্সে বসেছিলেন৷ কর্নেল ভন স্টাফেনবার্গ কনফারেন্স হলে ঢোকেন এবং হিটলারের পাশে বসে তাঁর টেবিলের সামনে একটি ব্রিফকেস রেখে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে যান৷ ওই ব্রিফকেসের মধ্যেই বোমা ছিল৷ কিন্তু বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগেই একটি হিটলারের একটি ফোন কল আসে৷ ফোনে কথা বলার জন্য ব্রিফকেস থেকে কিছুটা দূরে সরে যেতেই বিস্ফোরণ ঘটে৷ হিটলার প্রাণে বেঁচে যান৷ কিন্তু মারত্মকভাবে জখম হন তিনি৷